আদালতে বাড়ছেই মামলার জট
দেশের আদালতগুলোতে মামলার সংখ্যা বেড়েই চলছে। মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে মামলার জট।
বিশেষ করে উচ্চ আদালতে মামলার জট দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। এ বছরের শুরুতে দেশে বিচারাধীন মামলা ছিল ২৪ লাখ ৫৪ হাজার ৫৬০টি। ২০১১ সালের শেষে সব আদালত মিলিয়ে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল ২১ লাখ ৩২ হাজার ৪৬টি মামলা। অর্থাৎ দেড় বছরে মামলার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন লাখ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের শুরুতে দেশে বিচারাধীন মামলা ছিল ২০ লাখ ১০ হাজার ৩২৪টি। ওই বছর নতুন করে মামলা দায়ের এবং পুনরুজ্জীবিত হয় ১০ লাখ ৮৩ হাজার ৮২৭টি মামলা। মীমাংসা হয় ৯ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮৯টি। স্থানান্তর করা হয় ১৩ হাজার ১১৬টি।
সারাদেশে মামলার সংখ্যা:
সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সময় পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১৫ হাজার ৫শ’, হাইকোর্টে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৭৩১টি এবং নিম্ন আদালতে ২১ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮২টি মামলা ছিল।
সুপ্রিম কোর্টের ২০১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সালে আপিল বিভাগে বিচারপতি ছিলেন ১১ জন এবং বিচারাধীন মামলা ছিল পাঁচ হাজার ৬০টি। ওই বছর নতুন করে মামালা দায়ের করা হয় চার হাজার ৪০৩টি এবং মীমাংসা করা হয় ৬ হাজার ৩৫টি মামলা। ২০১০ সালে বিচারপতি ছিলেন আটজন, মামলা ছিল ৯ হাজার ১৪১টি। ওই বছর নতুন করে মামলা দায়ের করা হয় পাঁচ হাজার ৪৬৪টি মামলা, নিষ্পত্তি হয় ১ হাজার ৫৮৩টি। ২০১১ সালে বিচারপতি ছিলেন ১০ জন এবং মামলা ছিল ১২ হাজার ৪৪১টি। ওই বছর মামালা দায়ের করা হয় চার হাজার ৭৪৯টি মামলা, মীমাংসা হয় ১ হাজার ৪৪৯টি মামলা। বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারপতি রয়েছেন ৯ জন।
এদিকে হাইকোর্ট বিভাগে ২০০৯ সালে বিচারপতি ছিলেন ৭৮ জন, বিচারাধীন মামলা ছিল তিন লাখ ২৫ হাজার ৫৭১টি। ওই বছর নতুন করে দায়ের করা হয় ৫৩ হাজার ১৫৫টি মামলা, মীমাংসা হয় ২১ হাজার ৪৮৫টি মামলা। ২০১০ সালে বিচারপতি ছিলেন ৯৪ জন, মামলা ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭৩৫টি। নতুন করে দায়ের করা হয় ৫৭ হাজার ৪৭০টি, মীমাংসা হয় ৬৯ হাজার ৩০৬টি মামলা। ২০১১ সালে বিচারপতি ছিলেন ৯৮ জন, মামলা ছিল দুই লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৬টি। ওই বছর নতুন করে দায়ের করা হয় ৪৫ হাজার ৮৪টি এবং মীমাংসা হয় ৬৮ হাজার ৯১২টি মামলা। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ৯০ জন।
কিছুদিন আগে আইনমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, দেশে বর্তমানে ২৪ লাখ ৫৫ হাজার মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি বলেন, দীর্ঘসূত্রতার কারণে আদালতে মামলা জটের সৃষ্টি হয়। আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার ফলে মামলা জট কমবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এ বিষয়ে প্রধান বিচাপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন গত বছর এক অভিভাষণে বলেছিলেন আদালতের পূর্ণাঙ্গ সময়টুকু বিচার ও শুনানির কাজে লাগালে শুধু মামলা নিষ্পত্তির হারই বৃদ্ধি পাবে না বরং মামলার জটও কমবে।
মামলা জট প্রসঙ্গে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান বলেন, বিচারক ও বিচার কাজের সঙ্গে জড়িত লোকবলের সংখ্যা কম এবং তাদের প্রশিক্ষণের অভাব থাকায় মামলা জট বাড়ছে। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট ও ঢাকা জজকোর্টে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রবর্তন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোকের অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, তবে বর্তমান সরকার বিগত সরকারের চেয়ে মামলা নিরসনের ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, উচ্চ আদালতের মামলার জট বাধার কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে বাদী-বিবাদী মামলা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে একে অপরকে অহসযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করে এবং যোগ্য বিচারকের সংখ্যা কম। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি কোর্টে মামলা খুব তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হচ্ছে, অথচ অপর কোর্টের মামলাগুলো দেরিতে নিষ্পত্তি হতে দেখা যাচ্ছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, সরকার নিজ দলের নেতাকর্মীদের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে আর সাধারণ মানুষের মামলাগুলো দেরিতে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে। যার ফলে সাধারণ মানুষের মামলা দিন দিন বেড়েই চলছে। তিনি বলেন, আইনের দুর্বলতার কারণেও মামলার নিষ্পত্তি দেরিতে হয়। যার ফলে মামলার জট বেঁধে যায় খুব সহজেই। মামলার জট কমানোর জন্য তিনি মনে করেন সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, দেশের মানুষ নিম্ন আদালতের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। সংবিধানে স্বাধীন বিচারব্যবস্থার কথা থাকলেও সরকারের চাপে নিম্ন আদালতের বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। তিনি বলেন, মানুষ নিম্ন আদালতে সুষ্ঠু বিচার না পেয়ে উচ্চ আদালতে চলে আসছে। যার কারণে উচ্চ আদালতে মামলার জট দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। বিশেষ করে বর্তমান সরকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর কারণে-অকারণে মিথ্যা মামলা দিয়ে মামলার জট বাড়াচ্ছে। মামলার জট বাঁধার জন্য সরকারই মূলত বেশি দায়ী বলে তিনি মন্তব্য করেন। মামলা জটের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারের গণতান্ত্রিক আচরণের প্রতি গুরুত্ব দেন সিনিয়র এই আইনজীবী।