হিল্লা বিয়ে ও উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত
আইন ও মানবাধিকার ডেস্ক:
সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় দলপতি-নৃপতি-সমাজপতির হাত পেরিয়ে আধুনিক মানুষের বিচারব্যবস্থা এখন আদালতের হাতে ন্যস্ত রয়েছে। আদালতই হচ্ছে নাগরিকদের সম্পদ-সম্ভ্রম-অধিকারের সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদানকারী বৈধ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তবু এ কথা সত্য যে, বিশেষত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে হয়তো অনেকের পক্ষেই সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণে আদালতের সুরক্ষা চাওয়ার বা পাওয়ার সুযোগ থাকে না।
তা্ই বহু বছর আগে বড় দুঃখেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রতিবাদহীন শক্তের অপরাধে/ বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে।’ দেশে আইন-আদালত থাকা সত্ত্বেও বিচারের নামে ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি’।
আধুনিক সমাজকাঠামোতে অনেক পরিবর্তন এলেও বিয়ে-সংক্রান্ত সামাজিক রীতিনীতি ও অপসংস্কার এখনও মুছে যায়নি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে দাম্পত্য জীবনের নানা সমস্যা নিরসনের জন্য মুসলিম আইনে বিভিন্ন বিধানের যথাযথ প্রয়োগের নির্দেশ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা অকার্যকর করা হচ্ছে। সহজ-সরল মানুষের এসব আইন সম্পর্কে অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে গ্রামের মাতব্বর বা মোড়লেরা ফায়দা লুটছেন, বিভিন্ন উদ্ভট ফতোয়া জারি করছেন, যা মুসলিম আইনের পরিপন্থী।
হিল্লা বিয়ে নিয়েও এরকম অপপ্রচার-অপনীতি আজও আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজ করছে।
মূলত হিল্লা বিয়ে বলতে বোঝায়, কোনো তালাক দেওয়ার পর তৃতীয় ব্যক্তির কাছে একটি নিয়মের মাধ্যমে বিয়ে দেওয়ার পর ওই নারীকে পুনরায় আগের স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা। এ সম্পর্কে মুসলিম আইনে যথাযথ বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ২০০১ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চ ফতোয়াকে বেআইনি ঘোষণা করে। হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে এই রায়ে বলা হয়, হিল্লা বিয়ের ফতোয়া হচ্ছে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা নম্বর ৭ এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ধারা নম্বর ৪৯৪, ৪৯৮, ৫০৮ ও ৫০৯ লংঘন করা।
দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারায় স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় পুনরায় বিয়ে করার শাস্তি এবং ৪৯৮ ধারা কোন বিবাহিত নারীকে ফুসলিয়ে বা প্ররোচণায় আটকে রাখলে সশ্রম কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। ৫
০৮ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি অবৈধ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কাউকে জোরপূর্বক কোনো কাজে বাধ্য করলে, যা আইনত বাধ্য নয়, তাহলে দায়ী ব্যক্তি এক বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। ৫০৯ ধারানুসারে নারীর শালীনতার প্রতি অমর্যাদাকর কোনো কাজ বা মন্তব্যের জন্য শাস্তির বিধান আছে। হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়টি কোনো আপিল আদালতের নির্দেশে এখন পর্যন্ত স্থগিত আছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ নম্বর ধারাটি আমাদের সমাজে কতটুকু মানা হচ্ছে এবং এ সম্পর্কে সাধারণ জনগণ কতটুকুই বা জানে।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭-এ বলা আছে, যদি কোনো লোক তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে চান, তাহলে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে যত শিগগির সম্ভব লিখিত নোটিশ প্রদান করতে হবে এবং এর একটি কপি স্ত্রীকে দিতে হবে। নইলে তালাক কার্যকর হবে না। সুতরাং এখানে মৌখিক তালাকের অকার্যকরতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, নোটিশ জারি হওয়ার পর ৯০ দিন অতিবাহিত না হলে তালাক কার্যকর হবে না।
পূর্ণভাবে তালাক কার্যকর হওয়ার পর স্ত্রী যদি স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চান, তবে কাবিনের মাধ্যমে যথাযথ আইনগত পদ্ধতিতে পুনরায় বিয়ে করলেই যথেষ্ট হবে। এক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে সাময়িক বিয়ের প্রয়োজন নেই এবং তা তিন বার পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে। তবে ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশে হিল্লা বিয়ের কিছু সংশোধিত বিধি লিপিবদ্ধ আছে। দম্পতির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তালাক হয়ে যাওয়ার পর যদি উভয় পক্ষ মনে করেন তাঁরা পূর্বাবস্থায় ফিরতে ইচ্ছুক, তবে বিয়ের কাবিন মোতাবেক তৃতীয় বার পর্যন্ত পুনর্বিবাহ করা যায়।
কিন্তু তৃতীয়বারের পরে হিল্লা বিয়ের প্রয়োজন হবে। ১৯৬১ সালের এই আইনের কিছু বিধান নিয়ে মতভেদও রয়েছে। কিন্তু এই আইনের একটি ধারায় বলা আছে, এ আইন দেশে বলবৎ অন্য যে কোনো আইন বা প্রথা থেকে প্রাধান্য পাবে। আরবী ‘ফতোয়া’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘আইন সম্বন্ধীয় মত।’ প্রচলিত অর্থে ফতোয়া বলতে বোঝায় ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কিংবা এ ধর্মাবলম্বীদের দেওয়ানি বিষয়ে আইনগত মতামত। সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ অনুযায়ী, ধর্মীয় আইনবিশেষজ্ঞ বা ফিকাহশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ ফতোয়া দিতে পারেন। যাঁরা ফতোয়া দেন তাঁদের মুফতি বলা হয়। সাধারণত যেকোনো পরিস্থিতিতে যখন শরিয়ত-সম্পর্কিত অনুশাসনগুলোতে কোনো জটিল প্রশ্নের সরাসরি মীমাংসা পাওয়া যায় না, তখন মুফতিরা সাধারণত ফতোয়ার মাধ্যমে পূর্ববতী নজির এনে সমাধান দেন।
ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই বিভিন্ন ফতোয়া মুসলমান সমাজের প্রচলিত ধর্মীয় নিয়মেও পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ফতোয়ার এ সংজ্ঞাকে পাল্টে সাম্প্রদায়িক তুচ্ছ স্বার্থে বিব্রত করা হয়েছে, যার শিকার এখন বাংলাদেশের নিরক্ষর জনগণ। বর্তমানে যেসব ফতোয়া জারি করা হচ্ছে, তার মধ্যে দোররা মারা, পাথর ছুড়ে মারা, জুতাপেটা, মাথার চুল কেটে দেওয়া, বেঁধে পেটানো, মাটিতে অর্ধেক পুঁতে পাথর ছোড়া, হিল্লা বিয়ে দেওয়া প্রভৃতি।
এসব নির্দেশ কোনো মতেই ফতোয়ার সুষ্পষ্ট সংজ্ঞাকে সমর্থন করে না। সব ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানের আইনের সমতা বিধান, নারী-পুরুষের সমতা বিধান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার যেসব অনুচ্ছেদ লিপিবদ্ধ হয়েছে তা লংঘন। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার-সম্পর্কিত যেসব বিধান আছে, এর ২৭, ২৮, ৩১,ও ৩৫ অনুচ্ছেদের সরাসরি লংঘন। ২০০১ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের বেঞ্চ থেকে ফতোয়াকে যে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়, তা সাইফুল ও শাহিদা দম্পতির মৌখিক তালাকে ও হিল্লা বিয়েকে কেন্দ্র করে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া হয়।
এ রায়ে স্পষ্টভবে বলা হয়, এসব ফতোয়া বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইনসহ বিভিন্ন আইনের লংঘন করা হচ্ছে। এই রায়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের মতামত সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা একমাত্র আদালতেরই আছে। ফতোয়াবাজির ঘটনাকে আমলে নিতে ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশের প্রতি নির্দেশ, স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে সব স্কুল ও মাদ্রসায় পারিবারিক আইন পাঠ বাধ্যতামূলক করা প্রভৃতি।
এসব ফতোয়া বাংলাদেশের বিধিবদ্ধ ১৯৬১-এর মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ ধারার বহির্ভূত এবং এ আইনের সুষ্পষ্ট লংঘন।